বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা দাহ নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে দুই দেশে। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি ‘প্রতিবাদ নোট’ পাঠিয়েছে। ভারতীয় সরকারের এ প্রতিক্রিয়া শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নয়, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ঘটনার পটভূমি
১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। এদিন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। একই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন ভারতীয় সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগ। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের এই ঐতিহাসিক দিনে ভারত সাহসী সৈনিকদের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় অর্জন করেছিল।”
তবে মোদির এই বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। অনেকেই মনে করেন, এমন বক্তব্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখানো হয়েছে এবং এককভাবে ভারতীয় সেনাদের জয়গান করা হয়েছে।
সমালোচনা ও ছাত্র আন্দোলন
মোদির পোস্টের পর থেকেই বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ পোস্টটির তীব্র বিরোধিতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধিকার পরিষদ এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৮ ডিসেম্বর একটি মশাল মিছিলের আয়োজন করে। মিছিল শেষে তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
ছাত্রদের দাবি ছিল, মোদির বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করার শামিল। তারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এটি মূলত বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগের ফসল।
মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্ট
এই ঘটনার আগে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি ফেসবুক পোস্টে ভারতকে সমালোচনা করে আরও উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের চলমান ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভারত যদি শেখ হাসিনার পদত্যাগে ভূমিকা রাখে, তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক হবে।”
এই মন্তব্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত মনে করে, এটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্যই ক্ষতিকর।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
২০ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবাদ নোট পাঠায়। এতে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং অনুরোধ জানায় যে, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত সবসময়ই আগ্রহী। তবে এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।”
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সরাসরি এখনও কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের নোট গ্রহণ করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানানো হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন ভারতের প্রতিক্রিয়াকে বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ভারতকে আরো বেশি সংযমী হতে হবে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব
এই ঘটনাটি মূলত দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে দুই দেশের উত্তেজনার সুর স্পষ্ট।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা অপরিহার্য। ভারতের উচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সম্মান জানানো এবং মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক হওয়া।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে উভয়পক্ষেরই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের জন্যই সম্পর্কের স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনার সঠিক সমাধান দুই দেশের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের ।