জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানালেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এবার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই নির্বাচন নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্য সময়, ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ।

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি
অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষ দিক বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে নির্বাচন আয়োজনের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের কাজ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপরে।

তিনি বলেন, “যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করা হয়, তবে ২০২৫ সালের শেষের দিকেই নির্বাচন সম্ভব। আর যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে।”

ভোটার তালিকা হালনাগাদ: প্রথম চ্যালেঞ্জ

ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা নির্বাচনের প্রথম এবং অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। তার মতে, এই কাজটি যথেষ্ট জটিল এবং শ্রমসাধ্য।

গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ সীমিত ছিলো। ভোটার তালিকা যাচাইয়ের সুযোগও সেভাবে দেওয়া হয়নি। ফলে যারা গত ১৫ বছরে ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছেন, তাদের নাম সঠিকভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এখন অগ্রাধিকারের কাজ।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “এবারের নির্বাচনে অনেক তরুণ-তরুণী প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর এখানে কোনো ভুলেরই সুযোগ নেই।”

তরুণদের ভোটদান: নতুন অধ্যায়
তরুণ প্রজন্মের ভোটদানকে তিনি আসন্ন নির্বাচনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তরুণদের প্রথম ভোটের অভিজ্ঞতাকে স্মরণীয় করে তুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তার মতে, “আমার ইচ্ছা, তরুণ ভোটাররা ১০০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক। এটি নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

তরুণ ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে মজবুত করবে বলে তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন :  স্কুল ভর্তির লটারি আজ, যেভাবে জানা যাবে ফলাফল

প্রবাসীদের ভোটাধিকারের গুরুত্ব

অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এক বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই একটি ব্যবস্থা তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

তার মতে, “অতীতে এ নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার যেন এটি বাস্তবায়িত হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।”

নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কার: জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন

নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস মনে করেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে জাতীয় ঐকমত্য অপরিহার্য।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।”

ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টিভঙ্গি

অধ্যাপক ইউনূসের মতে, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে পারে। তিনি বলেন, “যদি আমরা এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার সাহস করবে না।”

তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, নির্বাচনে অংশগ্রহণ একটি গণতান্ত্রিক অধিকার, যা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া অপরিহার্য।

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি এবং চ্যালেঞ্জ

নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষ করে, ভোটার তালিকা যাচাই, প্রবাসী ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি এবং তরুণ ভোটারদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, “যদি আমরা এখন থেকে সঠিকভাবে কাজ শুরু করি, তবে একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে।”

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক সকল দলগুলোকে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সকল রাজনৈতিক দলকে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিভেদ এবং সহিংসতা এড়িয়ে সবাই মিলে কাজ করলেই কেবল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বপ্ন সফল হবে।”

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

সাধারণ মানুষ একটি নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এবারের নির্বাচনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চায় তারা।

আরও পড়ুন :  আজ থেকে চালু হচ্ছে বিআরটিসি’র এসি বাস সার্ভিস

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বক্তব্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মত বিশ্লেষকদের । নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং এর সফলতা নির্ভর করছে সকল পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর। আশা করা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে।